ঢাকা,রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

‘কথিত’ বন্দুকযুদ্ধে কাউন্সিলর একরামের মৃত্যুতে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও র‌্যাবের তথ্যগত ভুল

নুপা আলম :
টেকনাফে র‌্যাবের সাথে বন্দুক যুদ্ধে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক নিহত হওয়ার ঘটনায় ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় র‌্যাবের প্রেরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তথ্যগত ভুল লক্ষ্য করা গেছে। আর ভুল তথ্যের ভিত্তিতে একরামুল হক নিহত হয়েছেন কিনা তা তদন্ত করার দাবি উঠেছে। এলাকাবাসির দাবি কাউন্সিলর একরামুল হক ইয়াবা ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট নন, তার অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ ছিল।
গত শনিবার দিনগত রাত সাড়ে ১২ টায় কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে নোয়াখালিয়া পাড়ায় র‌্যাবের সাথে ‘কথিত’ বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালীপাড়ার মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে এবং একই ওয়ার্ডের পর পর তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর, টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও টেকনাফ বাস ষ্টেশন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এবং টেকনাফ হাইয়েছ মাইক্রো শ্রমিক ইউনিয়ন এর সাবেক আহবায়ক।
এ ঘটনার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আর র‌্যাবের ইমেল থেকে প্রেরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাতের অন্ধকারে নোয়াখালিয়া পাড়া থেকে একটি ইয়াবার চালান কক্সবাজার শহরে যাওয়ার কথা ছিল। এমন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব মেরিন ড্রাইভে অবস্থান নেয়। কিন্তু র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ইয়াবা পাচারকারীরা র‌্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। র‌্যাবও আতœরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে পাচারকারী দল পিছু হটে। এ সময় ঘটনাস্থলে একজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আহত ব্যক্তিকে টেকনাফ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ঘটনাস্থল তল্লাশী করে ১০ হাজার ইয়াবা, ১ টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ওয়ান শুটারগান, ১টি ম্যাগাজিন, ৬ রাউন্ড গুলি, ৫ রাউন্ড খালি খোসা ও ১টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে স্থানীয়দের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তি টেকনাফ পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোঃ একরামুল হক কমিশনার (৪৬) বলে শনাক্ত হয়।
র‌্যাবের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একরামুল হকের পিতার নাম বলা হয়েছে মোজাহার মিয়া প্রকাশ আব্দুস সাত্তার। যার বাড়ি টেকনাফ পৌরসভার নাজিরপাড়া। এতে বলা হয়, একরাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী এবং ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার। তার বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মাদক আইনে মামলা রয়েছে।
একরামের ভাই এহসানুল হক বাহাদুর জানান, একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকের কিছু লোক শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার ভাইকে ডেকে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বলে, জমি বিক্রির ব্যাপারে তারা একরামুলের সঙ্গে কথা বলতে চায়। কিন্তু পরে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পাই।
তিনি জানান, তাদের পিতার কোন প্রকাশ নাম ছিল না। আর টেকনাফ পৌরসভায় নাজিরপাড়া নামের কোন এলাকা নেই। নাজির পাড়ার মোজাহার মিয়ার অনেক পুত্র চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী। যে নাজির পাড়ার অবস্থান টেকনাফ পৌরসভার বাইরে টেকনাফ সদর ইউনিয়নে। র‌্যাব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে এমন ঘটনা সংঘটিত করেছে কিনা তা তদন্ত করা প্রয়োজন।
একরামের স্ত্রী আয়েশা খাতুন জানান, কোনকালেই একরাম ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার বিরুদ্ধে মামলাও নেই।
একই কথা বলেছেন টেকনাফ থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া। তিনি জানান, নিহত পৌর কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুইটি মামলা ছিল। যার একটি মারামারির অপরটি মাদক আইনে। মারামারির মামলাটি আদালতে শেষ হয়েছে। মাদকের মামলাটি তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না যাওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
একরাম নিহত হওয়ার পর কক্সবাজার জেলাব্যাপী আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ সচেতন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে গত দু’দিন ধরে নিন্দার ঝড় উঠছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওমর সালেহীন নামের একজন তীব্র ক্ষোভও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, “এটা ইয়াবা সম্রাট একরামুল হক কমিশনারের বাড়ী। ৭ বৎসর ধরে এভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। উনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের ১২ বৎসরের সভাপতি ছিলেন ও টেকনাফ পৌরসভার তিন তিন বার কাউন্সিলর। উনি এত বড় ইয়াবা সম্রাট যে ৭ বছর ধরে বাড়িটি পরিপূর্ণ করতে পারেননি। দেশের আনাচে-কানাচে উনার কোন স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আছে কেউ জানে না। শহরে-বন্দরে কোন আলিশান ফ্ল্যাট আছে কেউ জানে না। কোন নামী-দামী গাড়ীও নাই। রিক্সা চালক থেকে হঠাৎ কোটিপতি হওয়া লোকটিও নিজের ছেলেমেয়েকে চট্টগ্রাম-ঢাকা শহরে নামী-দামী স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। অথচ জন্মগতভাবে খানদানি ও আধুনিক ঘরের সন্তান একরামুল হক নিজের মেয়েদের পড়াচ্ছেন টেকনাফের বিজিবি স্কুলে। সত্যি বলতে কি এই শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী ক্রসফায়ার হওয়ার আগেও নিজের দুই মেয়ের স্কুলের খরচ যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তিনি আরও লিখেছেনে, জামাতির পোলা ইয়াবা ডন হাজী সাবরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ মেরে ফেলা হচ্ছে অর্থের অভাবে বাজার থেকে আধা কেজি মাছ নিয়ে ঘরে ফেরা সংগ্রামী যুবলীগ নেতা বা কর্মীকে।”
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে খোলা চিঠি লিখেছেন কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র, জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠণিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তিনি এ বিষয়ে তদন্ত করার দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহম্মদ আলী জানান, একরামের মৃত্যুর বিষয়টি টেকনাফের মানুষ সহজভাবে নিচ্ছে না। এটা কোথাও ভুল হয়েছে। বিষয়টি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিষ্কার করা জরুরী।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল বশর জানান, পৌর কাউন্সিলর একরাম বাড়ির নির্মাণ কাজ পর্যন্ত দীর্ঘদিনেও শেষ করতে পারেন নি। নিজের সন্তানদের স্কুলের বেতন দিতেও রীতিমত হিমশিম খেতে হত তাকে। তিনি ইয়াবা ব্যবসায়ী এটা হাস্যকর।

পাঠকের মতামত: